দিঘীর জলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আয়শার চোখে যেন এক খুশির ঝলক। আধো আধো কন্ঠে সিদ্দিক সাহেবের দিকে চোখ তুলে বলছে, ” পা…প্পা,ও… পা… প্পা। হাতের আঙ্গুল দিয়ে দিঘীর জলের দিকে দেখিয়ে – ওইটা কি?
মেয়ের এমন প্রশ্নে সিদ্দিক সাহেব দিঘীর জলে দৃষ্টিপাত করলো। স্বচ্ছে জলে কতগুলো মাছ খেলা করছে। কি জানি আয়শা হয়তো সেগুলো-ই দেখেছে৷ মেয়েকে আদর করতে করতে বললো, এগুলো হচ্ছে মাছ। এগুলো পানিতে খেলা করছে।
শিশু আয়শা যেন বাবার কথার কোনো সারেগামা বুঝতে পারেনি৷ আবারো আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, ওইটা কি?
সিদ্দিক সাহেবও যেন বুঝতে পারছেনা মেয়ের এমন বিব্রতকর প্রশ্ন৷ আকাশের পানে তাকিয়ে দেখলো। টুকরো মেঘের ভেলা আকাশ জুড়ে ছেয়ে আাছে৷ আচ্ছা, আয়শা সেই মেঘগুলোর কথা বলছে না তো?
পানির দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো, আয়শার প্রশ্নটা কোথায়। সত্যিই তো এতো ছোট্ট চোখের প্রখরতা যে ব্যাপক হয়ে ওঠতে পারে সেটা সিদ্দিক সাহেবের ধারণা-ই ছিলোনা।
মানুষের চিন্তার জগতে এমন অসংখ্য ছোট্ট বিষয় জড়িয়ে থাকে৷ অথচ আমরা কেউ অনুধাবন করতে পারিনা। প্রখর দৃষ্টির মাঝেও যে প্রবল সম্ভাবনার সুপ্ত বীজ লুকায়িত থাকে তা মানুষের বুঝা মুশকিল।
সিদ্দিক সাহেব মেয়েকে দিঘীর জলের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়শা হাত-পা ছড়াছড়ি করছে খুশিতে। সিদ্দিক সাহেব দিঘীর ঘাটে বসে স্বচ্ছ জলগুলো স্পর্শ করতেই যেন মেঘের টুকরোগুলো কম্পিত হচ্ছে।
আয়শার মুখে হাসি, চোখে খুশির চিহ্ন আর হৃদয়ে প্রকৃতির প্রতি এক অদৃশ্য মায়া। মেয়ের এমন খুশি দেখে সিদ্দিক সাহেবও অনেক খুশি।
ছোটবেলা থেকেই মেঘের প্রতি আয়শার এমন মায়া দেখে সিদ্দিক সাহেব তাকে ডাকতো মেঘের মেয়ে।
এতোসময় পেরিয়ে এলোও আয়শার সেই মায়া কাটেনি। এখনো মেঘ দেখলেই তার হৃদয় পুলকিত হয়। যেন মেঘের ছায়ার নিচে সে থাকতে চায় সবসময়। হয়তো কখনো কখনো মেঘগুলো তার পিছে পিছে ছুটে চলে দারুণ ছন্দে।
যখন রুক্ষ পৃথিবী রক্তিম সূর্যের উত্তাপে শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হয় তখন একটুকরো কালো মেঘের ভেলা-ই যেন পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি হয়ে আঁচড়ে পড়ে। আর প্রকৃতিকে আবারো প্রাণবন্ত করে।
সুরাইয়া বারান্দায় বসে নকশীকাঁথা সেলাই করছে। ছোট বেলায় আসমাকে এসব করতে দেখতো সে। তার খুব আগ্রহ ছিলো। মা আসমা বেগমের কাছে বসে থাকতো। এভাবে আস্তে আস্তে নকশীকাঁথার কাজগুলো আয়ত্ত করেছে সে। সুনিপুণ হস্তশৈলীর মাধ্যমে নিজের হৃদয়ের প্রতিচ্ছবিগুলোই যেন নকশীকাঁথায় ফুটিয়ে তুলে সে।
আয়শা বারান্দায় বসে আছে। তার মনটা আজ ভালো নেই। কেমন একটা উদাসীনতায় দিন কাটছে। মেয়েটা এমনিতেও শান্ত স্বভাবের। কোনো গল্প কিংবা কর্মে ব্যস্ত নয় সে। সুরাইয়ার মতো ঝিমধরে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়না তার। আয়শার কাছে এগুলো বিরক্তিকর ব্যাপার। আজকাল বাজার থেকে টাকা দিয়ে অনেক ভালো মানের নকশীকাঁথা পাওয়া যায়। কষ্ট করে বানানোর দরকার কি!
বারান্দা ছেড়ে সুরাইয়ার পাশে গিয়ে বসলো সে।
আচ্ছা, আপু। তোমার এইসব করতে বিরক্ত লাগেনা?
না তো, বিরক্ত লাগার কি আছে?
মানে সারাক্ষণ সুঁই সুতা নিয়ে বসে থাকা। কেমন জানি লাগেনা! তাই বললাম।
শুন আয়শা, যখন কোনো কাজ নিজের মন থেকে করবি তখন বিরক্ত লাগবেনা আর। আমি তো আমার কাজে আনন্দ পাই।
আয়শা সুরাইয়ার কথা শুনেও না শোনার ভান করে বললো, ঠিক আছে তুমি করতে থাকো। এসব আমাকে দিয়ে হবেনা৷
সে ভাবছে একটা গল্প লিখবে সে। কিন্তু কি নিয়ে গল্প লিখতে পারে তা ভাবার বিষয়। সে কি তার বড় বোন সুরাইয়াকে একটা গল্প লিখবে? নাহ, তাকে নিয়ে গল্প লিখলে তো নিজের কথাও লিখতে হবে। গল্পের অস্তিত্ব শেষ করে ফেলবে হয়তো। তাই আপাততঃ সুরাইয়াকে বাদ দিয়ে অন্য বিষয়ের দিকে মনপুত করলো সে।
মেঘ নিয়ে একটা গল্প লিখলে খারাপ হয়না। তার জীবনের সাথে মেঘের একটা অলৌকিক সম্পর্ক আছে হয়তো…..