আজকে শুক্রবার।শফিক সাহেবের তেমন কাজ নেয় আজকে।তিনতালার বারান্দায় বসে বসে আজকের পেপারটা পড়ছিলেন।তখন শারমিন(শফিক সাহেবের স্ত্রী)এসে বিরক্তি মুখে মাখামাখি করে বলে গেল,
বাজার আনতে হবে ঐটা বারবার মনে করিয়ে দিতে হয় কেন??বাজার কি শুধু আমার জন্য হয় নাকি।
শফিক সাহেব পেপারটা ভাজ করে টেবিলের উপরে রেখে উঠে দাঁড়ালেন।আলমারি থেকে সাদা পাঞ্জাবিটা বের করে নিলেন। ধীরেধীরে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।শারমিন না দেখে মতো বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এলেন।শারমিন দেখে ফেললে আবার কয়েকটা কটু কথা না শুনিয়ে ছাড়বেনা।দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় শুধু উঁচু গলায় বললেন,
শারমিন আমি যাচ্ছি দরজাটা একটু বন্ধ কর।
শারমিন আসার আগেই তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন।দ্বিতীয় তলায় আসতেই দেখা হয়ে গেল বাড়ির মালিক আহসানুদ্দিনের সাথে।শফিক সাহেব সালাম দিয়ে দাঁড়ালেন আহসানুদ্দিনের সামনে।আহসানুদ্দিনের বড় মেয়ে সেঁজুতির আগামীকাল বিয়ে।বিয়ের আয়োজনটা বেশ বড়সড় ভাবেই হচ্ছে।কোন ক্লাব ভাড়া করা হয়নি। তিনতলার ছাদে মস্ত বড় পেন্ডেল লাগানো হয়েছে। বড়সড় একটা স্টেজও বানানো হচ্ছে। ঐটা দেখার জন্য যাচ্ছেন আহসানুদ্দিন।শফিক সাহেবকে দেখেই হাসিমুখেই জিঙ্গেস করলেন,
ভালো আছেন?যাচ্ছেন কোথায়??
আলহামদুলিল্লাহ। যাচ্ছিলাম একটু বাজারের দিকে। আপনি ভালো আছেনতো??
আমিও ভালোই।মেয়ের বিয়েতে আসবেন কিন্তু।
জ্বি অবশ্যই আসব।
জানেন সেঁজুতি কি বলেছে?বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাস্তায় নামবে। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের মাঝে বিয়ের খাবারগুলো বিলিয়ে দিবে।
বাহ!!চমৎকারতো ক’জনই বা এমন চিন্তা করে।
আমিও চমকে গিয়েছিলাম। যাইহোক আপনি বাজার থেকে আসুন একসাথে বসে কথা বলব।
আচ্ছা।
শফিক সাহেব বাজারের থলেটা দুলাতে দুলাতে নিচে নেমে গেলেন।বড় রাস্তাটা ছেড়ে বাজারের সরু গলিটির মধ্যদিয়ে হাটতে লাগলেন।তেমন সুবিধার কিছু দেখছেননা বাজারে।সবজিগুলো সব মরামরা হয়ে আছে।এই মরামরা সবজিগুলো নিয়ে যাওয়ার চেয়ে না নিয়ে যাওয়ায় ভালো।শারমিন আবার রেগে আগুন হয়ে থাকবে।শফিক সাহেব এগিয়ে গেলেন আরেকটা সবজিওয়ালার কাছে। বেছে বেছে পটল নিলেন,শসা আর মিষ্টি কুমড়াও নিলেন।আরেকটু এগিয়ে রুই মাছ কিনলেন অনেক্ষণ দরাদরি করে।বাজারের রাস্তাটা ধরে বাড়ির দিকে ফেরার সময় রাস্তার মুখে দেখলেন আপেল বিক্রি হচ্ছে।শারমিনের আবার আপেল পছন্দ। শফিক সাহেব তাই আপেল দেখলেই কিনে ফেলেন।আজকেও ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি।সবকিছু নিয়ে ধীরেধীরে সিঁড়ি বেয়ে দরজার সামনে এসে কলিং বেলটা বাজালেন। সাথেসাথে শারমিন এসে দরজাটা খুলে দিল।বাজারের থলেটা রান্নাঘরে রেখে আস্তে করে কেটে পড়লেন।বিছানায় গা এলিয়ে শফিক সাহেব পা নাচাতে নাচাতে শুনলেন শারমিনের চেঁচামেচি শুরু হয়েছে।
চশমা ফ্যাশনের জন্য পড়ে থাকো নাকি। মাছের পেটটা পচে আছে ধরে দেখনি নাকি।আপেল এনেছ ঠিক আছে পচাগলা আছে নাকি একটু দেখবেনা।
শারমিন কথাগুলো বলে বলে পচা আপেলগুলো পলিথিনের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল।
বাজার করা কি এই জীবনে শিখা হবে না তোমার?
শারমিন পলিথিনের থলেটা জানালা দিয়ে রাস্তায় জমে থাকা ময়লার স্তুপের দিকে নিশানা করে ছুড়ে মারল।ময়লার স্তুপে ঝুপ করে শব্দ হওয়ায় রাস্তার ওপারে বসে থাকা তিনদিনের উপোস সাদা চুলের বুড়িটি লাঠিটা হাতে নিয়ে উঠে পড়ে।লাঠিতে ভর দিয়ে পা টেনেটেনে বুড়িটি ময়লার স্তুপের দিকে এগিয়ে যায়।শারমিনের ফেলে দেওয়া পলিথিনটি খুঁজে নিয়ে সেখানে বসেই পচা আপেলটা তৃপ্তি করে খায়।তার সাথে চার-পাঁচটা কুকুরও আছে।কিন্তু কুকুরগুলো তাকে কিছুই করবেনা।এই শহরের প্রত্যেকটা কুকুরই বুড়িকে চিনে।কারণ রোজ কুকুরগুলোর সাথে তার দেখা হয় কোন না কোন ময়লার স্তুপে।
রাত হয়ে এসেছে।বাড়িওয়ালার মেয়ে সেঁজুতির বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নিচে নেমে এল।কারের পেছনে খাবারের প্যাকেটগুলো একে একে তুলে দিল আহসানুদ্দিন।শফিক আর শারমিনও এলো বিদায় দিতে।ওপারের বুড়িটা খাবারগুলো রাস্তার মানুষদের জন্য শুনে সেঁজুতির দিকে এগিয়ে এল।একটা প্যাকেট তাকে দিতে বলার সাথেসাথে সেঁজুতি ধমকের সুরে বলল,
না, না।সব গণা গণা একটাও কম হলে হবে না।মানুষ হিসেব করে প্যাকেট নেওয়া হয়েছে।তোমাকে একটা দিয়ে দিলে হিসেবে কম পড়ে যাবে।
বুড়ি মুখটা কালো করে রাস্তার ওপারে গিয়ে এলোমেলো করে রাখা ইটের স্তুপের পাশে গায়ের শাড়িটা ভালোভাবে পেছিয়ে শুয়ে পড়ল।
সেঁজুতির গাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার পর শারমিন ধীরধীরে নিজেদের ঘরে ফিরল।রান্নাঘরে গিয়ে সব গুছিয়ে নিতে নিতে দেখল দুপুরের ভাত আর তরকারিগুলো থেকে হালকা পচা গন্ধ বের হচ্ছে।ভাত আর তরকারিগুলো পলিথিনে ভরে আবারও জানালা দিয়ে ময়লার স্তুপে ফেলে দিল।ময়লা পড়ার শব্দ শুনে বুড়িটি অন্ধকারে লাঠিটা খুঁজে নিয়ে ময়লার স্তুপের দিকে গেল।শারমিনের ফেলে দেওয়া ভাতগুলো তরকারি মেখে তৃপ্তি করে খেল বুড়িটি।বুড়িটির মনে হলো আহ!কত মজা খাবারগুলো।
সেঁজুতি খাবারের প্যাকেটগুলো রাস্তায় লাইন করে দাঁড়ানো মানুষদের দিতে লাগল।গাড়ির ড্রাইভারটা সেঁজুতির আর সেঁজুতির বরের ছবি তুলতে লাগল।শারমিন ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।বুড়িটি রাতের অন্ধকারে ময়লার স্তুপ থেকে ফেরার সময় একটা বড় ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে চলে গেল।মাথার মগজগুলো বের হয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল।রাতের অন্ধকারে কেউ বুড়িকে টের পেল না।